বইয়ের ধরণ: মুক্তিযুদ্ধ
সংস্কার: ফেব্রুয়ারি ২০১৮
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৩২১
প্রকাশনা: তৃপ্তি প্রকাশ কুঠি
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল হান্নানের স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃহত্তর কুষ্টিয়া বইটিতে বৃহত্তর কুষ্টিয়ার ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ কেন এবং কীভাবে ছড়িয়ে গেল, মাসওয়ারি যুদ্ধ, যুদ্ধের স্থান, বিজয়, থানাওয়ারী মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতা বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের অবদান, মুজিব বাহিনীর কমান্ডার তালিকা, ভারতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের তালিকা এমনকি একাত্তরের রাজাকারদের তালিকা স্থান পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপক জোরদার করতে সমগ্র দেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয় বৃহত্তর কুষ্টিয়া ৮ নং সেক্টরের অধীনে ছিল। প্রত্যেক সেক্টরে একজন করে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রত্যেক সেক্টরকে কয়েকটি সাব সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং প্রত্যেক সাব-সেক্টরে একজন করে সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন।
বইটির প্রথম অংশে স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ব কথা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন, পূর্বপাকিস্তানে মানুষের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান ঘটিয়ে নায্য হিস্যার দাবি করেছিলেন। অধিকার ও ন্যায্য হিস্যা আদায়ের লক্ষে আওয়ামী লীগ ৬ দফা এবং ছাত্রসমাজ ১১ দফা পেশ করেন। কমিউনিস্ট পার্টি, ভাসানী ন্যাপ সহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল এ দাবি সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, জামায়াত ইসলাম, মুসলিম লীগ সহ বেশকিছু দল এই দাবির বিপক্ষে ছিল।
এদেশের যে সকল মানুষ ছয় দফা আদায়ের জন্য সভা, মিছিল করেছিলেন তাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি নির্যাতনের সাথে সাথে অপবাদের শিকার হতে হয়েছিল।
২৫ শে মার্চ ১৯৭১ সাল থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত ৯ মাসের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ও ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে ১৪ হাজার ভারতীয় সৈন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এবং কয়েক হাজার সৈন্য আহত হয়েছিলেন। ভারত সরকার ও জনগণ প্রায় ১ কোটি দেশত্যাগি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য, আশ্রয়, প্রশিক্ষণ, গোলা-বারুদ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। এই যুদ্ধে আনুমানিক ১৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৮ হাজার মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি এবং এদেশীয় দোসরদের হাতে ৩০ লক্ষ মানুষ নির্বিচারে শহীদ হয়েছিলেন। প্রায় তিন লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল ও মুক্তিযোদ্ধাদের এবং মুজিব বাহিনীর নেতৃস্থানীয় নেতাদের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র কায়েমের চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতায় আসেন।
১৯৭৬ সালে সেক্টর কমান্ডার জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াত ইসলাম ও মুসলিম লীগ প্রার্থীকে রাজনীতি করার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেন এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের ৩৯ জনের নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছিল। তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেন জেনারেল জিয়াউর রহমান।
১৯৭৯ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের কমপ্লেক্স জাতীয় ফান্ড কমিটি গঠন করেন। কিন্তু ১৯৮১ সালে তিনি নিহত হয়। তার হত্যার অভিযোগে ৮ নং সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মো: আবুল মঞ্জুর নিহত হন।
১৯৮২ সালে জেনারেল এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায় আসেন। তিনিও স্বাধীনতার বিরোধী লোক নিয়ে সরকার গঠন করেন। তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের খসড়া তালিকা প্রকাশ করেন।
১৯৯১ সালে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান হিসেবে ক্ষমতায় আসেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসেন। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি, রাষ্ট্রীয় সম্মান ভাতা ও বোনাস প্রদান, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারে রেশন, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি যানবাহনে বিনা ভাড়ায় যাতায়াত, ফ্রি চিকিৎসা, মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন, সরকারি চাকরি, নাতি-নাতনীদের চাকরি, লেখাপড়া, মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির সময় বৃদ্ধি, বিজয় ও স্বাধীনতা দিবস জেলা / উপজেলা পর্যায়ে সংবর্ধনা ব্যবস্থা করেন।
দ্বিতীয় অংশে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এবং বৃহৎ আকার ধারণ করে। ভারতের বীরভূম জেলার রামপুর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং সংঘবদ্ধ আঘাত হানার প্রস্তুতির বর্ণনা করা হয়েছে। ২৬ শে মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনা উল্লেখ আছে।
বইটির শেষাংশে মুক্তিযোদ্ধা , গেরিলা কমান্ডার, মুজিব বাহিনীর কমান্ডার, ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, শান্তি কমিটির সদস্য এবং রাজাকারদের তালিকা, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা স্থান পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখক মোঃ আব্দুল হান্নান চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানা গেরিলা কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বইটি পড়ে আমার ভালো লেগেছে। এর মাধ্যমে আমি নিজ জেলার যুদ্ধের ইতিহাস যুদ্ধের ইতিহাস, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন জেলা ও থানার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ, যুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদান সম্পর্কে জানতে পেরেছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে “স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃহত্তর কুষ্টিয়া” বইটি এক অনন্য মাইলফলক।
~আনিকা আক্তার মাইশা
শিক্ষার্থী, আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজ।
[স্বয়ম্ভর পাবলিক লাইব্রেরি অন্তর্ভুক্তি নং ২১-১৩০]